পণ্য পরিবহনের জন্য প্রায় সময় আমাদের ট্রাকের প্রয়োজন হয়। কিন্তু হাতের কাছে টাইমলি ট্রাক মিলবে কোথায়? নিজে গিয়ে ভাড়া করার ঝক্কিও কম নয়। প্রয়োজনের সময় ট্রাক/পিকআপ ভাড়া করা হয়ে উঠতে পারে অন্যতম সমস্যার কারণ। ট্রাক স্ট্যান্ড খুঁজে বের করা, ভাড়া নিয়ে দরকষাকষি, আবার সঠিক ভাড়ার ধারনা না থাকায়- ট্রাক/পিকআপ ভাড়া বরাবরই সময়সাপেক্ষ এবং অনেক ঝামেলার বিষয়। আর এই সমস্যাগুলোর সমাধান নিয়ে অনলাইন এর মাধ্যমে ঘরে বসে ট্রাক সার্ভিস নেয়ার অন্য অন্যতম একটি ডিজিটাল ট্রাক রেন্টাল প্ল্যাটফর্ম “ট্রাক লাগবে”।
গণপরিবহন সমস্যার পাশাপাশি বাংলাদেশে পণ্য পরিবহনের সময়ও পারফেক্ট পরিবহন খুঁজে পাওয়াটা অনেকটাই ঝামেলার বিষয়, অনেক সময় ভাড়া করা নিয়েও পড়তে হয় বিপাকে। এই সমস্যাগুলোর সমাধান নিয়েই যাত্রা শুরু হয় “ট্রাক লাগবে” প্ল্যাটফর্মটির। বাংলাদেশের পণ্য পরিবহণ ব্যবস্থা আধুনিকায়নের লক্ষ্যে ট্রাক লাগবে তার যাত্রা শুরু করে ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে। এই দারুন আইডিয়াটি কাজ করছেন দুজন অসামান্য প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব এনায়াত রশিদ এবং মির হোসেন ইকরাম। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল ট্রাক ড্রাইভারদের জীবনের মান উন্নত করা এবং ট্রাক মালিক, ড্রাইভার আর সেবা নেয়া গ্রাহকদের মাঝে একটি সেতু বন্ধন তৈরী করা। বর্তমানে কোম্পানির সিইও এনায়েত রশিদ এবং সিওও মির হোসেন ইকরাম।
মূলত কোম্পনির বর্তমানে চীফ অপারেটিং অফিসার এনায়েত রশিদ পণ্য পরিবহনে প্রায়ই বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতেন এবং এই থেকেই “ট্রাক লাগবে” প্ল্যাটফর্মটির প্ল্যান মাথায় আসে। পণ্য পরিবহণের জন্য ট্রাক বা পিকআপ ভাড়ার এই সমস্যা দূর করতে, “ট্রাক লাগবে” পুরো ঢাকা সিটি জুড়ে পিকআপ ভাড়ার সুবিধা দিচ্ছে। প্রথম থেকেই নতুন নতুন আপডেটের মাধ্যমে বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ মানুষের জন্য ট্রাক ভাড়ার পদ্ধতি সহজতর করে চলেছে ট্রাক লাগবে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের পরিবহন সমস্যা সমাধানে কাজ করছে দেশের জনপ্রিয় এই স্টার্টআপটি।
পণ্য পরিবহন সমস্যার কথা মাথায় রেখে ঘরে বসেই প্রয়োজনে ট্রাক রিজার্ভ করা এবং পারফেক্ট দামে ভাড়া করার সুবিধা দিয়ে এসেছে দেশীয় অ্যাপভিত্তিক এই পরিবহন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানটি। অর্থাৎ ঘরে বসে অ্যাপের মাধ্যমে যেকোনো ধরনের ট্রাক আপনি ভাড়া করতে পারছেন। ট্রাক অপারেটররাও অ্যাপটি ব্যবহার করে ফিরতি পথে নতুন ভাড়া পেতে সক্ষম হচ্ছেন। যার কারণে ফিরে আসার পথে তাদের পুনরায় খালি ফিরে আসা সম্ভাবনাও অনেক কম। আবার অনেক সময় ট্রাকে পণ্য তুলে দেওয়ার পর দুশ্চিন্তায় থাকতে হয় যে ট্রাকচালক ঠিকভাবে পণ্য পৌঁছে দেবেন তো?এ সমস্যারও সমাধান পাওয়া যাবে অ্যাপের মাধ্যমে সেবা নিলে, এখানে সেবাগ্রহীতা অনেকখানি চিন্তামুক্ত থাকতে পারবেন। কারণ, তিনি জানতে পারবেন, চালকসহ ট্রাকমালিকের বিস্তারিত তথ্য এবং তাঁর পণ্য নিয়ে ট্রাকটি এখন কোথায় অবস্থান করছে, সেটাও। বর্তমানে “ট্রাক লাগবে” র প্রতিটি ট্রাক ভেরিফাইড।
এই প্ল্যাটফর্ম রেজিস্ট্রেশেনের জন্য, ট্রাক মালিকের এবং ট্রাকের প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদান করতে হয়। আর এসব তথ্য সংরক্ষিত থাকায় আপনার পণ্য যে সুরক্ষিতভাবে জায়গামত পৌছে যাবে এই বিষয়ে রয়েছে শতভাগ নিশ্চয়তা। এমনও দেখা যায় যে ট্রাকে পণ্য তুলে দিয়ে তার সাথে একজন লোক দিতে হয় পণ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। এতসব ঝামেলা এড়ানোর জন্যই সবচেয়ে সহজ উপায় এখন হাতের মুঠোয়। পেনডেমিক এই সময়ে ভয়াবহতা দিন দিন আরো বেড়ে চলেছে, বিশেষ করে এই দ্বিতীয় ঢেউয়ে আমাদের আরো সাবধান হওয়া উচিত। এ অবস্থাতেও অনেকেই প্রয়োজনের তাগিদে প্রতি মাসেই বাসা বদল করছেন।
একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে ২০২০ সালের মার্চ থেকে জুন মাস সময়কালে আনুমানিক ৫০,০০০ হাজার এর বেশি বাসা বদল হয়েছিল। “ট্রাক লাগবে” করোনা পরিস্থিতির শুরু থেকেই প্রফেশনাল শিফটিং সার্ভিস দিয়ে আসছে ঢাকা সিটি এবং ঢাকা সিটি থেকে দেশের অন্যত্র। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন মেগাপ্রজেক্ট এবং উন্নয়ন প্রকল্পের পরিবহন সেবা নিরবিচ্ছিন্ন রাখতে ট্রাক ভাড়ার ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম “ট্রাক লাগবে” সারা দেশে প্রজেক্ট লজিস্টিক্স সার্ভিস চালু করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের অন্যতম প্রধাণ দুইটি প্রকল্প রূপপুর নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে নিয়মিত পরিবহনসেবা দেওয়ার পাশাপাশি কর্পোরেট সার্ভিস এবং দেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে পাথর, বালু, মাটি সহ সকল ধরনের কন্সট্রাকশন মালামাল পরিবহনে কাজ করে চলেছে ট্রাক লাগবে।
ইতিমধ্যে ভারী মেশিনারিজ, পোলট্রি ফিড, সিমেন্টের কাঁচামাল, সার এবং কয়লা সেগমেন্টেও কার্যক্রম প্রসারণের জন্য কাজ করছে ট্রাক লাগবে’র প্রজেক্ট লজিস্টিক্স টিম। এর ফলে যেকোনো বড় এবং মাঝারি ধরনের প্রজেক্টের জন্য সময়মত লজিস্টিক সেবা প্রদান, প্রফেশনাল সার্ভিস এবং ডিজিটালাইজড পরিবহন সেবা নিশ্চিত করা আরো সহজ হচ্ছে গতানুগতিক পরিবহন সেবার তুলনায়। এই সেবার আওতায় বর্তমানে, প্রফেশনাল এবং ডিজিটালাইজড লজিস্টিক সেবা, প্রজেক্টের জন্য প্রয়োজনীয় সবধরনের ডাম্প ট্রাক, খোলা ট্রাক এবং ট্রেইলার প্রদান, ডেডিকেটেড কি একাউন্ট ম্যানেজার, ২৪ ঘন্টা নিরবিচ্ছিন্ন কাস্টমার সেবা, ভেরিফাইড ট্রাক এবং ড্রাইভার সুবিধা প্রোভাইড করছে সংস্থাটি শুরু থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ১০ লাখ এর বেশি ট্রিপ সম্পন্ন হয়েছে এই অ্যাপ থেকে। মাত্র ৩৬ টি ট্রাক নিয়ে তাদের যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে তাদের রেজিস্টার্ড ট্রাক এর সংখ্যা দাড়িয়েছে ৫০ হাজার এর বেশি। এছাড়াও বর্তমানে ট্রাক লাগবে প্ল্যাটফর্মটি বাংলাদেশের বিগেস্ট এগ্রিটেক প্ল্যাটফর্ম “আইফার্মার” এর সাথেও পার্টনারশিপ এর মাধ্যমে কাজ করে আসছে।
ট্রাক লাগবে শুরু করার প্ল্যান ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসেই শুরু হয় এবং ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সরকার এর আইসিটি এর আন্ডার এ অর্গানাইজ করা “স্টার্টআপ চ্যালেঞ্জ ২০১৭ “তে প্রথম স্থান অধিকার করে। ২০ টি উদ্ভাবনী প্রকল্প থেকে “ট্রাক লাগবে” কে প্রথম স্থানের জন্য বাছাই করা হয়। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে তাদের অ্যাপটির ট্রায়াল ভার্সন বের করা হয় এন্ড্রোয়েড ইউসার দেড় জন্য যা পরবর্তীতে ২০১৮ সালের অগাস্ট এ গুগল প্লে স্টোরে অ্যাপ ভার্সন হিসেবে রিলিজ করা হয়। ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে “ট্রাক লাগবে” বেস্ট টেকনোলজি ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ড অর্জন করে যা বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরাম এর আন্ডার এ অর্গানাইজ করা হয়েছিল।
ট্রাক লাগবে এখন পর্যন্ত টোটাল ৩ টি ইনভেস্টমেন্ট রাউন্ডে মোট ৬.৩ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেছে। তাদের সর্বশেষ অর্থায়ন ২০২১ সালের ০১ ফেব্রুয়ারি সিরিজ এ রাউন্ড থেকে উত্থাপিত হয়েছিল। এই স্টার্টআপটি এখন পর্যন্ত ০৭ টি ইনভেস্টর থেকে তাদের ফান্ড কালেক্ট করেছে। তাদের মোস্ট রিসেন্ট ইনভেস্ট পার্টনার হলে “দুবাই বেসড ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্ম “Shorooq Partners” এবং গ্লোবাল ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ড “Seedstars” এছাড়াও তাদের লিড ইনভেস্টর হিসেবে তালিকাভুক্ত রয়েছে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক এর প্রাইভেট সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট উইং ইন্টারন্যাশনাল ফিনান্স কর্পোরেশন, দ্যা আরিয়া গ্রুপ, মাউন্ট পার্কার ভেঞ্চার এবং আরসি ভেঞ্চার এর মতো ফার্মগুলো।
ট্রাক লাগবে অ্যাপটির মূল লক্ষ্যই হচ্ছে সবার কাছে তাদের সার্ভিসটি পৌঁছে দেয়া। ট্রাক ড্রাইভার দের সার্ভিস দেয়ার জন্য অনেক রিমোট এরিয়া তে যেতে হয় এবং আসার সময় খালি ট্রাক ফিরিয়ে নিতে হয় যার কারণে তাদের শ্রম এবং টাকা দুটোয় খরচ হয়। কিন্তু ট্রাক লাগবে অ্যাপটির মাধ্যমে নতুন কাস্টমার পাওয়ার যাবে ফেরার পথে যা তাদের এক্সট্রা ইনকাম। এইভাবেই ট্রাক লাগবে ট্রাক মালিক, ড্রাইভার, শ্রমিক এবং পরিষেবা গ্রহণকারীদের জীবন আরও বেশি সহজ করে দেয়া এবং সেবা নেওয়া গ্রাহক দের মাঝে একটি সেতু বন্ধন তৈরী করা।