২০২২ সাল নাগাদ বৈশ্বিক কোভিড পরিস্থিতি স্তিমিত হবার সমান্তরালে, যে কয়টি আশংকা জনমনে আলোড়ন তুলেছিল, তার একটি শ্রীলংকার সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। বিপুল বৈদেশিক ঋনের চাপে পিষ্ট দেশটি দাতা দেশগুলোর বেধে দেয়া সময়সীমার ভেতর ঋন শোধ করতে পারবে, না কি নিজেকে দেউলিয়া ঘোষনা করার মত অস্বস্তিকর পথে হাঁটবে?
শ্রীলংকার পরিস্থিতি নিয়ে সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন বৈশ্বিক মোড়ল থেকে শুরু করে সাধারন জনগন।
সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে গত ১২ই এপ্রিল ক্ষমতাসীন রাজপাকশে সরকার বিদ্যমান ৫১০০ কোটি ডলার বৈদেশিক ঋন পরিশোধে সাময়িক স্থগিতাদেশ প্রনয়ন করে যা প্রকারান্তে দেউলিয়া ঘোষনার সামিল।
এই বিবৃতির মাধ্যমে দক্ষিন এশিয়ার প্রথম দেউলিয়া ঘোষনাকারী দেশ হিসেবে ইতিহাসে নাম লেখালো শ্রীলংকা। গ্রীস বৈশ্বিক হিসেবে প্রথম। একই দেশের একাধিকবার নিজেদের দেউলিয়া ঘোষনা করার ইতিহাসও কম বিস্তৃত নয়। দক্ষিন আমেরিকার দেশ ভেনেজুয়েলা, কোস্টারিকা, আর্জেন্টিনা, এমনকি বিশ্বের নবম বৃহত্তম অর্থনৈতিক দেশ ব্রাজিলের একাধিকবার নিজেদের দেউলিয়া ঘোষনা করার নজির আছে। কোভিড মহামারীর প্রতিক্রিয়ায় দেউলিয়া ঘোষনার দ্বারপ্রান্তে আছে বেশ কিছু দেশ।
শ্রীলংকার পরিস্থিতির পেছনের গল্প
আপাতদৃষ্টিতে কোভিড মহামারীকে দায়ী করা হলেও, অনেক বোদ্ধা মনে করেন শ্রীলংকার পরিস্থিতি এই দূরাবস্থার পেছনে মৌলিক দায় রাজনৈতিক দুষ্টচক্র, গোতাবায়ে সরকারের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, এবং চীনের বেল্ট এন্ড হাইওয়ে প্রকল্পের ঋনফাঁদ, যা শ্রীলংকাকে বিপদজনক ভবিষ্যতের দিকে হাঁটতে প্রলুব্ধ করেছিল।
২০১৯ সালে গোতাবায়ে রাজাপাক্ষে শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট মনোনীত হন। প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাক্ষেকে, যিনি সম্পর্কে গোতাবায়ের বড় ভাই। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মাহিন্দা রাজাপাকশের নিয়োগ ছিল সংবিধান বহির্ভূত প্রক্রিয়ায়, যা তখন ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। শুধু মাহিন্দা নন, শ্রীলংকার মন্ত্রীসভার গুরুত্বপূর্ণ ১১ টি পদ দখলে নেন রাজাপাক্ষে পরিবারের বিভিন্ন সদস্যরা। প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের সেক্রেটারিয়েটে জায়গা পান যারা, তারা মূলত রাজাপাক্ষের পরিবার থেকে উঠে আসা।

শাসনচক্রে একই পরিবারের আধিপত্য শ্রীলংকার রাষ্ট্রীয় স্বার্থকে কোনঠাসা করতে শুরু করে। তার প্রমান পাওয়া যায় ২০১৯ সালে গোতাবায়ের নেয়া এক সিদ্ধান্তে। সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তিনি ভ্যাট কমানোর সিদ্ধান্ত নেন। মূল্য সংযোজন কর ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে এক ধাক্কায় ৮ শতাংশ করা হল। বছর পার হতেই দেখা গেল সার্বিক রাজস্ব আয় কমে গেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। ভুল শুধরে নেবারও সময় পাননি গোতাবায়ে, কেননা ততদিনে বিশ্ব ব্যাপী কোভিড মহামারীর প্রকোপ শুরু হয়ে গেছে। ভ্যাট বাড়াবেন কি, উল্টো ক্ষতিগ্রস্থদের আর্থিক প্রনোদনা দেয়া জরুরী হয়ে পড়ে।
রাজাপক্ষ ভাতৃদয়ের ক্ষমতায় আসার আরেকটি বিজ্ঞাপন ছিলো শ্রীলংকাকে দক্ষিন এশিয়ার সিঙ্গাপুর বানানো। রাজাপক্ষদের মাথায় এই পোকার অনুপ্রবেশ করিয়েছিল চীন, তাদের বেল্ট এন্ড রোড ইনশিয়েটিভ এর মূলো দেখিয়ে।
গোতাবায়ের বড় ভাই, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকশে, প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন মেয়াদে চীনা বন্দর নির্মান প্রতিষ্ঠান সিএমপোর্টের সাথে দক্ষিন শ্রীলংকার হাম্বানটোটায়, গভীর সমুদ্র বন্দর-শহর নির্মানের একটি চুক্তি করেন। যা করা হয় চীন থেকেই বিপুল অংকের ঋন নিয়ে। উল্লেখ্য, হাম্বানটোটা রাজাপক্ষে পরিবারের আবাসভূমি ও নির্বাচনী এলাকা। ২০১৭ সালে বন্দরটি যখন চালু হয়, সময়ের পরিক্রমায় দেখা গেলো প্রকল্পটি তৎকালীন সরকারের অপরিনামদর্শী সিদ্ধান্ত ছাড়া কিছুই নয়। চালু হবার পরবর্তী দুই বছরে মাত্র চারটি জাহাজ হাম্বানটোটায় যাত্রা বিরতি দেয়। ততদিনে চীন ও বিভিন্ন দাতাদেশ, অর্থ সংস্থা থেকে বিভিন্ন প্রকল্পের বিপরীতে বিপুল পরিমান ঋন নিয়ে ফেলেছে শ্রীলংকান সরকার। অবস্থা বেগতিক দেখে ১.২ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে সরকার হাম্ববানটোটা বন্দরটি চীনের কাছে লিজ দেয়। এই বিপুল পরিমান অর্থ উৎপাদনশীল ক্ষেত্রে কাজে না লাগিয়ে, বৈদেশিক রিজার্ভ হিসেবে ব্যবহার করে সরকার। বস্তুত, এই রিজার্ভ দেখিয়ে দাতা দেশ থেকে আরো ঋন নেবার পথ তৈরী করা হয়।
কোভিড মহামারী আঘাত হানার আগেও, শ্রীলংকার পরিস্থিতি হয় খুব ভয়ানক। সেই সময় শুধু চীনের কাছেই ঋন দাড়ায় পাঁচ বিলিয়ন ডলারে। এরপর মহামারীর প্রভাবে দেশটির মূল বানিজ্য খাত পযর্টনে ব্যাপক ধস নামে। রেমিটেন্স প্রদানকারী প্রবাসী লংকানরা দেশে ফিরে আসেন। এতে রিজার্ভ ডলারের সার্বিক প্রবাহ ব্যাহত হয়। ডলার বাঁচাতে সরকার আমদানীর উপর খড়গহস্ত হয়। অর্গানিক কৃষি’র নাম করে সার আমদানী বন্ধ ঘোষনা করে। বিপাকে পড়েন কৃষকরা। খাদ্য উৎপাদন আশংকাজনক হারে নীচে নেমে আসে। সরকারের অর্গানিক কৃষি প্রকল্প বুমেরাং হয়ে সরকারের গালেই চপটাঘাত করে।

মুদ্রাস্ফীতি স্বরনকালের সব রেকর্ড কে ছাপিয়ে যায়। এক ডলারের বিপরীতে শ্রীলংকান রুপির সর্বশেষ মূল্য ছিলো ২৯০ রুপি। গোদের উপর বিষফোড়া হয়ে দাড়ায় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, পশ্চিমা দেশগুলির নিষেধাজ্ঞায় রাশিয়া থেকে তেল সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। ব্যারেল প্রতি তেলের দাম হু হু করে বাড়তে থাকে। যা ইতোমধ্যে সাধারন শ্রীলংকানদের ক্রয়সীমার বাইরে চলে গেছে। তেলের পাম্পের দীর্ঘ লাইনে দাড়িয়ে মারা যায় দুজন লংকান নাগরিক, কাঁচামাল আমদানী বন্ধ হওয়ায় কাগজ উৎপাদন হয়নি, কাগজের অভাবে পরীক্ষা দিতে পারেনি দশ লাখ শিক্ষার্থী। এনার্জি ব্যালেন্সের জন্য সরকারে প্রতিদিন ১০ ঘন্টা নূন্যতম লোডশেডিং এর ঘোষনা দেয়, যা কার্যত শ্রীলংকার নাগরিকদের দূদর্শার বিজ্ঞাপন হয়ে বিশ্বের শীর্ষ স্থানীয় গনমাধ্যমগুলির শিরোনাম হয়ে সেঁটে যায়। এরপর থেকে কার্যত শ্রীলংকার পরিস্থিতি দেউলিয়া ঘোষনার কাল গননা শুরু হয়ে যায়।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে, সর্বশেষ ৫১০০ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋন শোধে সরকার অপারগতা জানায়। যার ভেতর বাংলাদেশের দেয়া ২৫ মিলিয়ন ডলারও আটকে গেছে।
কেমন আছে বাংলাদেশ??
কোভিড মহামারীর প্রকোপে অনেক দেশ কমবেশি অর্থনৈতিক মন্দায় পড়েছে। আবার সামলেও নিয়েছে। শ্রীলংকার পরিস্থিতি এক্ষেত্রে ব্যাতিক্রম হলেও, আমরা দেখতে পাই মূল সমস্যাটি হয়েছে দেশটির সার্বিক রাজনীতি একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মুঠোয় চলে যাওয়ায়। গত এক দশক ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিও একই চক্রে আবর্তিত হচ্ছে, তাই আশংকা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।
তাছাড়া সাম্প্রতিক মুদ্রাস্ফীতি, এই আশংকাকে আরও উষ্কে দিচ্ছে।

তবে আশার কথা এই, বাংলাদেশের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করা মৌলিক প্যারামিটার গুলো ক্রমশ স্বস্তিদায়ক অবস্থার দিকে যাচ্ছে। পশ্চিমা দেশগুলির সাথে চীনের বিরোধের জেরে গার্মেন্টসগুলি আশাতীত ক্রয় আদেশ পেয়েছে। ফ্লাইট চলাচল স্বাভাবিক হওয়ায় প্রবাসী গমনের হার বেড়েছে। এই প্রবাসীরা ইতোমধ্যে রেমিট্যান্স পাঠানো শুরু করেছেন, ফলশ্রুতিতে বৈদেশিক রিজার্ভ আগের থেকে আরও শক্ত অবস্থানে যাবে বলে আশা করা যায়।
বর্তমানে বাংলাদেশের বিদেশী ঋনের হার জিডিপির ১৩ শতাংশ, আইএমএফের হিসেবে এই হার ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত সহনীয়। পরিকল্পনা মন্ত্রী তার এক বিবৃতিতে বলেছেন, “বাংলাদেশ আর শ্রীলংকার পরিস্থিতি এক নয়।”