বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যেখানে এখনো বিয়ের অর্থ ধরা হয় নারীদের কর্মজীবনের সমাপ্তি, যেখানে আজও নারীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত নয় সেখানে আমাদের দেশের সফল নারীরা অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছেন পদে পদে হতে পারে সেটা চাকরি বা বিজনেস এবং কৃতিত্বের স্বীকৃতী পেয়ে যাচ্ছেন দেশের সীমানার বাইরেও।
নারীদের প্রতি বৈষম্য প্রায় সব ক্ষেত্রেই রয়েছে। এমনকি একজন নারী কোথাও কাজ শুরু করলে, তার উচ্চপদে যাওয়ার সম্ভবনা খুব কম থাকে এবং সেখানে কমবেশি লিঙ্গ বৈষম্যের মুখোমুখি হতে হয়। অতীতের কিছু নারীদের সাফল্য প্রমাণ করেছে যে, সুযোগ পেলে নারীরাও এগিয়ে যেতে পারে উন্নতির শীর্ষে। এইসব বাঁধা অতিক্রম করে কিছু নারী আজ তাদের কর্মজীবনে উচ্চপদ অর্জন করেছেন। সঠিক প্রশিক্ষণ, শিক্ষা এবং দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির বলে তারা তাদের পরিশ্রম সবার সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। চলুন জানি সাম্প্রতিক সময়ের এমন কিছু নারীদের কথা যারা বাংলাদেশের নারীদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়িয়েছেন।
হুমায়রা আজম
বাংলাদেশের কমার্শিয়াল ব্যাংকিং এর প্রথম মহিলা সিইও হলেন হুমায়রা আজম। সম্প্রতি তিনি ট্রাস্ট ব্যাংকের সিইও হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন। ১৯৯০ সালে, তিনি কর্মজীবন শুরু করেন এএনজেড গ্রিন্ডলেজ ব্যাংকের (ANZ Grindlays Bank) প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাপক হিসেবে। বেশ কয়েকটি মর্যাদাপূর্ণ পদে কাজ করার পর, অবশেষে ২০০৯ সালের এপ্রিল মাসে আইপিডিসি বাংলাদেশের ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং সিইও হিসেবে যোগদান করেন এবং কোম্পানির সমৃদ্ধিতে ব্যাপক অবদান রাখেন। হুমাইরা ২০১২ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ব্যাংক এশিয়ায় উপ -ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং চিফ রিস্ক অফিসার হিসেবে কাজ করেন। পরে তিনি ২০১৮ সালে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে ট্রাস্ট ব্যাংকে যোগদান করেন।
সোনিয়া বশির কবির
সোনিয়া বশির কবির, বাংলাদেশের প্রথম মহিলা টেক ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট। তিনি উন্নয়নশীল দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর টেক স্টার্ট-আপগুলিতে মনোনিবেশ করা, এসবিকে টেক ভেনচারস এবং এসবিকে ফাউন্ডেশনের (SBK Tech Ventures & SBK Foundation) প্রতিষ্ঠাতা। ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি- ইস্ট বে থেকে বিএসসি এবং সান্তা ক্লারা ইউনিভার্সিটি থেকে ফিন্যান্স অ্যান্ড মার্কেটিংয়ে এমবিএ শেষ করার পর থেকে সোনিয়া থেমে নেই এবং তার পকেটে রয়েছে অসংখ্য অর্জন।
তিনি বাংলাদেশ, নেপাল, মায়ানমার, ভুটান ও লাওসের মাইক্রোসফটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে জুন ২০১৪ থেকে মে ২০১৯ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৬ সালে, বিল গেটসের হাতে মাইক্রোসফটের মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠাতা পুরস্কারের পাঁচজন প্রাপকের একজন ছিলেন সোনিয়া বশির কবির। বর্তমানে, সোনিয়া বশির কবির আইপিডিসি ফাইন্যান্স (নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান), ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ এবং শক্তি ফাউন্ডেশনের বোর্ড সদস্য।
আইভি হক রাসেল
আইভি হক রাসেল মায়ার প্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও, যা একটি অনলাইন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান। প্রতি ১৪ সেকেন্ডে মায়ার পরামর্শদাতারা পরামর্শ প্রদান করেন। মহিলাদের সুস্থতার জন্য আইভির উদ্বেগ তাকে মায়া তৈরি করতে প্ররোচিত করেছে, যা আগে মায়া আপা নামে পরিচিত ছিল। নারীরা পরিচয় গোপন করে সাহায্য চাইতে পারে মায়ার মাধ্যমে। তিনি যুক্তরাজ্যে এইচএসবিসি অল্টারনেটিভ ইনভেস্টমেন্টসের একজন সাবেক বিশ্লেষকও ছিলেন।
এছাড়াও “মায়া” বাংলাদেশের প্রথম ডিজিটাল পার্সোনাল ওয়েলবিয়িং এসিস্টেন্ট যা মহিলাদের স্বাস্থ্যসেবা, অনলাইন হেল্থ এবং হেলথ রিলেটেড অন-ডিমান্ড ইনফরমেশন প্রোভাইড করার একটি জনপ্রিয় প্লাটফর্ম। ২০১৪ সালে বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে মহিলাদের শারীরিক স্বাস্থ্য, মানসিক স্বাস্থ্য এবং আইনী সেবার মতো সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য একটি নামহীন নিরাপদ ম্যাসেজিং প্ল্যাটফর্মের প্রস্তাব দিয়ে এটি যাত্রা শুরু করেছিল । ২০১৫ সালে ব্র্যাক এর সহযোগিতায় মায়া এপপ্সটি লঞ্চ করা হয়।
একজন গ্রাহক এখানে খুব সহজেই তাদের হেলথ রিলেটেড যেকোনো প্রশ্ন পোস্ট করতে পারে, যা বিশেষজ্ঞের একটি নিরীক্ষিত নেটওয়ার্কে পৌঁছায় এবং একটি উপযুক্ত রিপ্লাই পাওয়া যায়। মায়া বর্তমানে একটি নামহীন নিরাপদ ম্যাসেজিং এর পাশাপাশি যে কোনো মানুষের জন্য হেল্থ , সাইকোলজি , সোশ্যাল প্রব্লেম এবং লিগ্যাল সমস্যাগুলোর ওন ডিমান্ড এক্সপার্ট সুবিধা দিয়ে আসছে।
আপনি এসএমএস এবং অ্যাপের মাধ্যমে মায়ার অন-ডিমান্ড বিশেষজ্ঞদের পুল থেকে তথ্য এবং পরামর্শ পেতে পারেন খুব সহজেই , তাদের প্রিমিয়াম সেবার জন্য উত্তর পেতে সময় লাগেমাত্র ১০ মিনিট। মায়ার প্রথমদিকে , যেকোন প্রশ্নের যথাযথ পদ্ধতিতে উত্তর দিতে প্রায় ৪৮ ঘন্টা সময় লাগলেও পরবর্তীতে এটি ২৪ ঘন্টা এবং তারপরে ১২ ঘন্টায় হয়ে ওঠে এবং গত কয়েক বছর ধরে এটি মাত্র ০৩ ঘন্টায় এই সেবা দিয়ে আসছে এবং বর্তমানে প্রিমিয়াম ব্যবহারকারীরা এটি ১০ মিনিটের মধ্যে পেয়ে যাচ্ছেন।
মালিহা এম কাদির
সহজ এর প্রতিষ্ঠাতা এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক মালিহা কাদির শীর্ষস্থানীয় মহিলা প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে স্বীকৃত পেয়েছেন। তিনি হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল থেকে এমবিএ সম্পন্ন করেন। মালিহা কাদির স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের সহযোগী পরিচালকও ছিলেন।
মালিহা এম কাদির বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ সুপার অ্যাপ সহজের প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক। খাদ্য সরবরাহ থেকে শুরু করে রাইড-শেয়ারিং, টিকিট, স্বাস্থ্য এবং লজিস্টিক পরিসেবা সহ বিস্তৃত পরিসেবা প্রদান করে এই প্রতিষ্ঠানটি। সহজ বিভিন্ন ইউরোপীয় ও এশিয়ান ইনভেস্টরদের কাছ থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমের সবচেয়ে বড় রাউন্ডের ফান্ডিং সংগ্রহ করেছে। বর্তমানে সহজ ব্যবহারকারী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫০ লক্ষ এবং সহজে কর্মরত রয়েছে ৩০০ এর বেশি মানুষ।
হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের এমবিএ ধারক মালিহা এম কাদির, স্মিথ কলেজ থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। বাংলাদেশে ফেরার আগে, তিনি আমেরিকা ও সিঙ্গাপুরে ব্যাংকিং এবং টেকনোলোজির কিছু স্বনামধন্য সংস্থা যেমন মর্গান স্ট্যানলি, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, নোকিয়া এবং ভিস্তাপ্রিন্টের মতো সংস্থায় এক দশক কাজ করেছেন।
মালিহা এম কাদির ইউকে বিজনেস ইনসাইডার ম্যাগাজিন অনুযায়ী শীর্ষ ১০০ গ্লোবাল ফিমেল ফাউন্ডার তালিকায় রয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে সেরা মহিলা আইসিটি উদ্যোক্তা পুরস্কার, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম কর্তৃক ইয়াং গ্লোবাল লিডার হিসেবে স্বীকৃতি, ডেইলি স্টার বেস্ট আইসিটি স্টার্টআপ অফ দ্য ইয়ার এবং অনন্যা ম্যাগাজিনের সেরা দশ অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছেন।
টিনা জাবীন
টিনা এফ জাবীন স্টার্টআপ বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক। “স্টার্টআপ বাংলাদেশ” দেশের প্রথম ভেঞ্চার ক্যাপিটাল কোম্পানি যাকে বাংলাদেশ সরকার ৫০০ কোটি টাকা ফান্ড দেয়ার জন্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। স্টার্টআপ বাংলাদেশের সিইও হিসেবে টিনা অনেক সংস্থাকে ফান্ড পেতে এবং তাদের স্টার্ট-আপ শুরু করতে সাহায্য করেছেন । টিনা আইসিটি মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র পলিসি অ্যাডভাইজার হিসেবেও কর্মরত রয়েছেন। গত কয়েক বছর ধরে, টিনা আইসিটি মন্ত্রণালয়কে এশিয়া, উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপ জুড়ে সরকারি এবং বেসরকারি ইন্ডাস্ট্রিতে পলিসি ও ইনভেস্টমেন্ট করতে সহায়তা করছেন। তিনি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বার্কলে, হাস স্কুল অফ বিজনেস থেকে অ্যাকাউন্টিং এবং ফিন্যান্সে বিএ অনার্স সম্পন্ন করেছেন।
শাম্মী কুদ্দুস
শাম্মী কুদ্দুস গুগলে প্রোডাক্ট ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছেন। তিনি একজন অসাধারণ মেধাবী ছাত্রী ছিলেন এবং এমআইটি থেকে পরিবেশ বিজ্ঞান বিষয়ে বিএসসি সম্পন্ন করেছেন। তিনি বিওয়াইএলসি গ্রাজুয়েট নেটওয়ার্কের যুব নেতৃত্ব প্রোগ্রামের সহ-প্রতিষ্ঠাতা। ওয়াটারহেলথ ইন্টারন্যাশনাল সংস্থায় (বাংলাদেশ) ৩ বছর কাজ করার পর, শাম্মী স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি, গ্রাজুয়েট স্কুল অফ বিজনেসে এমবিএ এবং হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি, জন এফ কেনেডি স্কুল অফ গভর্নমেন্টে মাস্টার্স অব পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের জন্য আবেদন করেছিলেন।
যখন তিনি দুটো বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই অফার লেটার পান তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে দ্বৈত ডিগ্রি অর্জনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবেন। ১৬ বছর বয়সে শাম্মী কুদ্দুস ক্যারাটে ট্রেনিং শুরু করেন এবং তিনি জানান এটি তার আত্ম-বিকাশের যাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল কারণ বাংলাদেশের মেয়েরা খেলাধুলার তেমন সুযোগ পায় না।